Tuesday 7 June 2022

বাঁশবাগানের ভূত -- সাবিত্রী দাস

বাঁশবাগানের ভূত
সাবিত্রী দাস

আজ যে এত দেরী হয়ে যাবে কে জানতো! পরের হাটবারে ভোর থাকতে বেরোলে দুধ বেচে ঠিক সময়ে  ফিরতে পারবে পানুর  একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। কুসুম পুর পার হয়ে গেলেও নাহয় কথা ছিল!  কুসুমপুর থেকে আরো মাইল দুয়েক যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে।
তখনো কুসুমপুর  গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ আসেনি,শুধু কুসুমপুর নয়, ধলাজুড়ি, আমডাঙা, কাজলাডাঙা, বীর হাটী এই গ্রামগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। দামোদর নদীর পাড়ে হাট বসতো সপ্তাহে দুদিন মঙ্গলবার আর শুক্রবার। কুসুমপুর , আশপাশের আরো চার পাঁচটা গ্রামের  লোকজন ঐ হাটেই যাবতীয় কেনাবেচা করতো।এ জন্য  হাটের দিন গুলোতে  কেনাবেচা সেরে আসতে আসতে কোন কোন দিন সন্ধ্যাও হয়ে যেত। হাট থেকে কুসুমপুরের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার মতো। হাট থেকে কুসুমপুরের পথে অনেক  ঝোপঝাড় খানাখন্দ ছিল। তখনকার দিনে গ্রামের রাস্তা আর কেমন হবে!  বীর হাটি  ছিল কুসুমপুর থেকে আরো দু মাইলের পথ। বীর হাটির পানু ঘোষ দুধ নিয়ে হাটে বেচতে যায়, সেদিন সব দুধ বিক্রি হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেল।
কুসুমপুরের পথে বাঁশবাগানে তেনারা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন,অনেকেরই এ বিষয়ে  অভিজ্ঞতা আছে। একথা মনে পড়তেই  গা ছমছম করা একটা অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরলো। যাই হোক, যতই ভয় করুক বাড়ী তো ফিরতেই হবে।  সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ ,সন্ধ্যা নেমে আসার ঠিক আগের সময় মুখ আঁধারে বাঁশবাগানের কাছে  পৌঁছাতেই দেখে রাস্তায় লম্বালম্বি বাঁশগুলো পড়ে আছে। ভেতরে ভেতরে যতই ভয় ভয় করুক না কেন বাঁশগুলো না ডিঙোলে তো যাওয়াই যাবে না। যা হয় হোক ভেবে  যেই না বাঁশ পার হতে গেছে গোটা বাঁশঝাড় সাঁ সাঁ করে উঠে গেছে উপরে। পানু একটা পা বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে  তাকে শুদ্ধ নিয়েই বাঁশঝাড় ক্রমশ উপরে উঠতে থাকলো।বীভৎস একটা মুখ খ্যাক খ্যাক করে হাসছে, ঐ মুখটা তো হরুর! তিনবছর আগে এই বাঁশ বাগানেই গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। ভয়ে হাত পা শরীর কাঁপতে লাগলো , দুধের ফাঁকা ক্যান, হাট থেকে কিনে আনা জিনিস গুলো হাত থেকে ছিটকে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় পানু তো আঁ আঁ করতে করতে  ছিটকে পড়েছে রাস্তায় বলা বাহুল্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়েছে।পরের দিন সকালে যখন তার ঘুম ভাঙলো দেখে বাড়ীতে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে।

                ভাগ্য ভালো বলতে হবে, ভাগ্যিস তখন বীরহাটির  মধু ডাক্তার রোগী দেখে ফিরছিলেন। পানুকে রাস্তায় বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে বোঝেন পানু ব্যাটা কিছু একটা দেখে ভয়ে বেঁহুশ হয়ে গেছে। নিজের গাড়ীতে তুলে নিয়ে পানুর বাড়ীতে পৌঁছে দেন।

জাম পুকুর--সন্ধ্যা রায়


জামপুকুর--সন্ধ্যা রায়

আমি এক সরকারি চাকুরে। এই গ্রামে নতুন এসেছি। আমার ঘরের চারদিকে বাগান, পাশেই একটা বড় বিশাল বাড়ি। বাড়িটা অনেক পুরনো, অনেকটা সাবেকি বাংলো টাইপের। আমার ঘর সোজা রাস্তাটা গিয়ে বড় রাস্তায় মিশেছে। আবার ওই বড় রাস্তাটা চলে গেছে শহরের দিকে। আমি ঘরের জালনার পাশে বসে সোজা রাস্তার ওপারে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। দূরের ঐ পাহাড়টা সবুজ গাছে ঘেরা। নীল আকাশ, বড় মনোরম এই দৃশ্য। হঠাৎ সামনে একটা বাচ্চা আর এক মহিলাকে ছুটে বেড়াতে দেখলাম। মনে হচ্ছে ওরা দুজনে খেলছে। ওরা দুজন মা ও ছেলে হবে। গ্রামের মহিলার মাথায় বড় ঘোমটা, তার মুখ দেখা যায় না। জালনা থেকে আমি ওদের খেলা দেখছিলাম। সকালটা বেশ ভালো কাটলো। আবার অফিসে বেরোলাম। জনা ছয়েক স্টাফ। প্রথম দিন সবার সঙ্গে মিলেমিশে গল্প করে সময় কাটলো। অফিস থেকে বেরোবার মুখে আমার বন্ধু, অর্কর ফোন এলো, সে বলল, রঙ্গন, ভাবলাম তোর অফিস আর তার পাশের গ্রামটা একবার দেখে আসবো--

রঙ্গন বলল, ভালই তো, আয়না আমি অফিসের সামনে একটা ছোট হোটেলে বসে চা খাচ্ছি। তারপর তুই এসে গেলে একসাথে রাতের খাবার খেয়ে দুজনে গ্রামে ফিরব । তুই আয়, রঙগন বলল আমি ততক্ষণ এখানেই আছি । 

অর্ক বলল, আচ্ছা রাখছি বাস আসছে আমি বাসে উঠছি । বলে অর্ক ফোনটা রেখে দিল ।

রঙ্গন মনে মনে ভাবতে লাগলো। এই হোটেলটা রাস্তার ওপরে বলে যত লরি বাস-ট্যাক্সি কার যাচ্ছে, ড্রাইভার যাত্রীদের অনেকেই এখানে চা নাস্তা করে নিচ্ছে । কেউ আবার দুপুরে আর রাতের খাবার খেয়ে যায় আমার ভালোই হয়েছে । ভাবছি এখানকার নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যাব । এরপর সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে বসলাম। সামনে অস্তগামী সূর্য, এত সুন্দর দৃশ্য। এই দৃশ্য দেখার জন্য লোকেরা কোথায় না কোথায় যায়! আর আজ আমি চোখের সামনে এখানেই দেখতে পাচ্ছি । সুদূর প্রসারিত হলুদ সরষে খেতটা যেন দিগন্তে মিশে গেছে । আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের কোনটা অন্ধকারে ঢেকে রেখেছে । দুই পাহাড়ের মাঝে সূর্যটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। যেন কোন পটে আঁকা ছবি। কি মনোরম দৃশ্য। কালকে অর্ককেও  দেখাবো। সূর্য গেল সেই অতলে তলিয়ে, চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো। বেশকিছু গাড়ি আলো ছড়িয়ে দিয়ে নিমেষে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ নামছে, উঠছে। এর ভেতরেই পৌঁছে গেল  অর্ক । খুশি হলাম ওকে দেখে, এই অন্ধকারে এত সময় একা বসেছিলাম । দুজনে মিলে চা খেলাম।

একটু পরেই দেখছি পেছন থেকে চাঁদের উদয় হলো চাঁদ টা দেখে মনে হচ্ছে মাত্র দু তিন দিন পরেই পূর্ণিমা হবে । অর্ক চাঁদের আলোতে চারপাশটা দেখে খুব খুশি হল। হোটেল থেকে আমরা রাতের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম ঘরের দিকে । বিরাট খোলা মাঠ দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারল না অর্ক খুব আনন্দে গান ধরল   ------- ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে, কারো নজর লাগতে পারে  ।   গানের শেষে এসে পৌ্ছালাম ঘরের  সামনে । তখনই দারোয়ান এসে বলল --- বাবু তোমাকে কর্তামশাই ডেকেছে কথা আছে।  

রঙ্গন বলল কোথায় যাব? 

দারোয়ান বললো, ওই যে পাশের বাড়িটা, ওটাতে-- 

রঙ্গন বলল, ওখানে তো কোন আলো দেখি নি , ওর দরজায় সব সময় একটা বড় তালা ঝুলানো থাকে।  

লোকটা বলল, এখন যান, পাবেন, ঘর খোলা আছে । 

রঙ্গন বলল, ঠিক আছে, কাল যাব । 

আচ্ছা, বলে দারোয়ান চলে গেল । 

দুই বন্ধুতে অনেক গল্প গুজব হল তারপর ঘুমিয়ে পরল রাতে। হঠাৎ প্রচনড শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে গেল । অর্ক বলল, একি এতো জোরে আওয়াজ ? একটু পরেই বাসনের জোরে আওয়াজ হল। রঙ্গন বলল, এতো বড় বাড়ি হয়ত অনেক লোকজন আছে । একটু পরেই জোরে জলের আওয়াজ হল যেন নদীতে বান এসেছে । 

রঙ্গন বলে উঠলো, বাইরে বর্ষা হচ্ছে না তো ? ওরা বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে দেখলো। ওরা চুপচাপ শুয়ে আছে, কোন কথা নেই। একটু পরে ওরা অনেক লোকজনের আওয়াজ শুনতে পেল। রঙ্গন ভাবল, ও দিনের বেলায় অনেকটা সময় ছিল না, তাই হয়ত লোকজন থাকার কথা জানতে পারেনি। ও জানে না দিনেও এমন হয় কি না। 

ভোরের দিকে ওদের চোখে ঘুম এল। সকালে উঠতেও দেরী হয়ে গেল। সকালে ওরা দেখল বাইরে রাতের বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। রঙ্গন অফিসে যাওয়ার মুখে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখল সেই তালাবন্ধ ঘর। এখানে কেউ থাকে না নাকি? রঙ্গনের মনে ভয়ের উদয় হল। ও ভাবল এখানে থাকবো না, গ্রামের ভেতরে গিয়ে কোন ঘর নিয়ে থাকব । দুই বন্ধু চুপচাপ ভাবতে ভাবতে হোটেলে পৌঁছাল। হোটেলবালাকে জিজ্ঞেস করল, ওই বড় পুরনো বাড়িতে কেউ থাকে না নাকি ? হোটেলওয়ালা বলল, ওখানে ত কেউ থাকে না, ওই বাড়ির পেছনে এক বড় গভীর জলাশয় আছে, নাম তার জামপুকুর। শুনেছি, ওই বাড়ির বড় কর্তার নাতি ওই জলে পড়ে যায় আর ওকে বাঁচাতে গিয়ে ওর ছেলে আর ছেলে বউ দুজনেই মারা যায়। পরে বুড়ো কর্তাও  মারা গেছে শুনেছিলাম। তারপর গ্রামের লোকেরা কেউ গরু চরাতে গেলে বা বাচ্চারা ভুলে চলে গেলে কেউ নাকি বেঁচে ফেরে না। গ্রামের লোকেরা গিয়ে দেখে জলে পড়ে মরে আছে। এ সব শুনে রঙ্গন অফিসে গেল। নিজের কাজ করে কাউকে কিছু না বলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় মতলব আটল এখানে আর সে থাকবে না । বলল, বুঝলি অর্ক এখানে থাকা চলবে না । চলে যাব । 

অর্ক বললো, ঠিক বলেছিস চল, আমার সঙ্গে চল। ব্যাগটা নিয়ে আসি আগে । সন্ধ্যায় গিয়ে দেখে বড় বাড়ীটা তালা খোলা। রঙ্গন বললো, একবার দেখা করে আসি। ওরা দুজনেই গেল। ওরা দেখল টেবিলে একটা হারিকেন জ্বলছে, ঘরটা স্যাঁতস্যাঁতে । সীতানাথ মুখুজ্যে মশায় বসে আছেন । রঙ্গনরা যেতেই ওদের বসতে বলল । অর্ক দাঁড়িয়েই ছিল। রঙ্গন পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে দিয়ে বলল, আমি আর থাকব না এখানে । আমার মন টিকছে না । সীতানাথ ইয়া বড় চোখ তুলে বলল, কেন সে কি? কি হয়েছে ? চিৎকার করলেন তিনি। 

অর্ক ওর চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল । ও উঠে দাঁড়ালো । তখন ভেতর থেকে ওই ঘোমটা দেওয়া বউটা আর ছোট ছেলেটা বেরিয়ে এলো । ওরা জোরে জোরে হাসতে থাকলো । রঙ্গনরা দেখল, বউটা ঘোমটা খুলে দাঁড়িয়ে, ও একটা কঙ্কাল। ছেলেটা আর সীতানাথ বাবুও তাই--ওরাও কঙ্কাল। হারিকেনের আলোয় রঙ্গন ও অর্ক দেখতে পেল, অন্ধকারে কুড়ি পঁচিশটা আরো কঙ্কাল এসে দাঁড়িয়ে। কঙ্কালরা অট্টহাসি হাসছে। ওই আওয়াজে আর ভয়ে রঙ্গন মূর্ছা গেল। ওকে টেনে নিয়ে বারান্দায় এসে  অর্ক চিৎকার করে উঠলো--হেল্প, হেল্প--কেউ কি আছেন ?

অন্ধকারে কেউ এলো না। হঠাৎ ওর মনে হল, ওর ব্যাগে জলের বোতলটা আছে। ও তাড়াতাড়ি জলের বোতলটা থেকে জল নিয়ে রঙ্গনের চোখে দিল । রঙ্গন তাড়াতাড়ি উঠে বসলো সম্বিৎ ফিরতেই দুজন প্রচন্ড দৌড়ে সোজা দোকানে এসে বসে পড়ল। 

রঙ্গন দোকানদারকে বলল, বাস কখন আসবে ? 

দোকানদার বলল, বাস ত এখনই বেরিয়ে গেল । আবার সেই ঘন্টা দুই পরে লাস্ট বাস কিন্তু আশ্চর্য একটু পরেই একটা বাস এলো! ওরা তড়িঘড়ি করেই সেই বাসে উঠে বসলো, দেখল, প্যাসেঞ্জারের সবাই ঠান্ডায় চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে।  অর্কর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, বুঝলি আমরা বড় বাঁচা বাঁচলাম । 

বাস অন্ধকারে ছুটে চলেছে। রাস্তায় লোক উঠছে - নামছে।  আর কিছু পরে ওদেরও নামতে হবে। হঠাৎ ওরা দেখতে পেল, ওদের মোড় এসে গেছে। রংগন দাঁড়িয়ে বললো, থামাও থামাও, সিঁথির মোড় এসে গেছে। আমরা নামব-- 

বাস থামল না, অর্ক চিত্কার করে উঠলো, থামাও থামাও রঙ্গনের চিৎকারে বাসের সবাই পেছনে ঘুরে তাকাতেই রঙ্গন আর অর্ক দেখলো সামনে বসে ওরা সবকটা কঙ্কাল! এবার ওরা চিৎকার করতে করতে বাসের দরজার কাছে এসে সজোরে ধাক্কা মারলো । এক মুহূর্তের জন্য বাস থামল আর দরজা খুলে গেল । অর্করা  দুজনে ভয়ে হাত ধরাধরি করে নামছে । দুজনে যেন কাঁপছে । নেমে ওরা সামনেই দেখল ওই ঘোমটা দেওয়া বউ আর তার ছেলেটা, কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে। সামনে এমনি কঙ্কাল দেখে রঙ্গন আর অর্ক ভয়ে চিৎকার করে উঠল। মহিলা আর ছেলেটা বাসে উঠতেই অট্টহাসির আওয়াজে চার দিক যেন ভরে গেলো। বাসটা অন্ধকারে ছুটতে শুরু করল, আর মুহূর্তের মধ্যেই কোথাও মিলিয়ে গেল।  

সমাপ্ত

Monday 6 June 2022

একটি রহস্যময় ঘটনা--শুভ্রব্রত রায়



একটি রহস্যময় ঘটনা--শুভ্রব্রত রায়

একদিন একটি রাত্রিতে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কারণ সেই সময় ছিল বর্ষাকাল। সারাদিন প্রবল বৃষ্টির হওয়ার পর যখন খানিকটা বৃষ্টির পরিমাণ ও ঝড় হাওয়ার দাপট কমল, তখন প্লাটফর্মে একটাও লোক নেই। প্লাটফর্মের এদিক-ওদিক শুনশান। অর্ক বলে একটি ছেলে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে বাড়ি ফিরবে বলে। কারণ তার বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরে। কিন্তু ট্রেন আসতে অনেক দেরী, তাই অর্ক প্লাটফর্মের একটি বেঞ্চে পা তুলে বসল, রাত্রি তখন প্রায় ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজে। তখন সে ভাবলো এই ঠান্ডা আবহাওয়াতে একটু চা পেলে ভালোই হতো, কথাটা ভাবা মাত্রই দেখল সে-খানিকটা দূরে একটি লোক চায়ের কাপ ও কেটলী হাতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছ। তৎক্ষণাৎ অর্ক হাত নেড়ে লোকটিকে ডাকল। অর্ক বলল এক কাপ চা দিন। লোকটি বলল চা নেই বাবু কফি আছে। অর্ক শুনে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে ভাবলো "আরও ভালো"। এই ভেবে সে এক কাপ কফি কিনে খেতে লাগলো আর প্লাটফর্মেট পাইচারি করতে লাগলো।
  হঠাৎ খানিকটা দূরে তার দৃষ্টি পড়ল, সেখানে একটা একটা কী যেন একটা পড়ে আছে। দূর থেকে বিদ্যুতের আলোতে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তাই অর্ক একটু এগিয়ে গেল সেই দিকে। আর দেখল একটি মানুষ পড়ে আছে রেল লাইনের ধারে। সে ভাবল লোকটি হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে বা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। তখন প্রায় রাত্রি নটা বাজে।
ঠিক আর একটু বাদেই রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ ট্রেন আসবে। তাই অঘটনের আশঙ্কায় তার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাই তাকে সেই রেল লাইন থেকে তোলার জন্য অনেক ডাকাডাকি করতে লাগলো। কিন্তু অর্ক লোকটির কোনো সাড়া পেলনা, সাড়া না পেয়ে লোকটির ডান হাতটি ধরে সজোরে হ্যাঁচকা টান দিল। এ কী! বরফের মতো ঠান্ডা তার হাত। কিন্তু তার শরীরের পোশাকটা তো ভদ্রলোকদের মতোই মনে হচ্ছে। আর একটি জিনিস তাকে অবাক করে দিল। লোকটির ডান হাতের তর্জনী যেন লাইনের পাশের ঝোপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। সে অনেক চেষ্টা করে লোকেটির দুটি পা টেনে তাকে লাইনের বাইরে নিয়ে এল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার! তার তার ডান হাতের তর্জনী সেই ঝোপের দিকেই রয়েছে। 
সে তখন কৌতুহল বশত সেই ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল। পায়ে করে ঝোপগুলি সরাতেই তার চোখে পড়ল একটি কালো ব্যাগ। সে আরও কৌতুহল হয়ে পড়ল ব্যাগটি তাড়াতাড়ি খোলার জন্য। ব্যাগটি খুলে সে দেখল পাঁচ লক্ষ টাকা। অর্ক তখন ভাবতে লাগলো এত টাকা নিয়ে লোকটি কোথায় যাচ্ছিল? তার পরিচয়টাই বা কী? এইভাবেই সে ব্যাগটি আরও ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখল কয়েকটি বিবাহের কার্ড রয়েছে। তাতে পাত্র-পাত্রীর পিতা ও মাতার নাম লেখা। তবে কী লোকটির ছেলের বা মেয়ের বিবাহ? সে কৌতূহল হয়ে কার্ডটি পড়ল এবং ঠিক করল সব জেনে লোকটিকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। এই ভেবেই অর্ক যেই পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লোকটিকে দেখার জন্য যেখানে তাকে সে রেখেছিল। কিন্তু কোথায় কী? কেউ তো নেই! তন্ন তন্ন করে অর্ক খুঁজল চারপাশ। কিন্তু জড়াজীর্ণ লোকটিকে কোথাও দেখা গেল না।
এখন সে কী করবে সেটাই ভাবতে লাগলো হতভম্ব হয়ে। ভাবতে ভাবতে কার্ডে লেখা ঠিকানাতেই সে যাবে মনস্থির করল। প্রথমে সে পাত্রীর পিতার ঠিকানাতেই যাবে বলে ঠিক করল। কারণ, তার মনে হচ্ছিল সেখানেই তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সে পাবে।
রাত্রি অনেক হয়ে গিয়েছিল, সমস্ত ট্রেন চলে গিয়েছিল। তাই অর্ক ঠিক করে রাতটা এই করিমপুর প্লাটফর্মেই কাটিয়ে পরের দিন খুব ভোরের ট্রেনে সে রওনা দেবে সেই ঠিকানার উদ্দেশ্য। সেইমত পরের দিন রাত পোহাতেই ভোর হতেই অর্ক তার গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা দিল। খোঁজ করতে করতে সে যখন সেই বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল, তখন কিছু লোক তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দেখছিল। কারণ, অর্ক সেই এলাকাতে আগে কখনও যায়নি।
বাড়ির সামনে আসতেই এক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেসা করলেন-"আপনি কি বরপক্ষের কেউ?" অর্ক উত্তর দিতে উদ্যত হলে সেই ভদ্রলোকটি অর্ককে থামিয়ে দিয়ে বলল-"দেখুন, এখানে একটু অসুবিধা হয়ে গেছে। গত পরশুদিন থেকে ভুপেনবাবু নিখোঁজ, তিনি পরশুদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন কিছু নিমন্ত্রণপত্র বিলি করতে আর বরপনের টাকা যোগাড় করতে। কিন্তু দুটি রাত পেরিয়ে গেল, আজও তিনি ফেরেননি। সেক্ষেত্রে বিয়েটা যে কী করে হবে, তা বুঝতে পারছি না"।
এই কথা শুনেই অর্ক সেই কালো ব্যাগটা তার দিকে এগিয়ে দিল এবং বলল, -" দেখুন তো, এই ব্যাগটি ভুপেনবাবুর ব্যাগ কিনা? টাকা-পয়সা যা ছিল, তা-ই-আছে। ব্যাগটি হাতে পেয়ে ভুপেনবাবুর বাড়ির সদস্যদের উজ্জ্বল মুখগুলো দেখে অর্ক তার পূর্বদিনের ঘটনার কথা আর বলতে পারল না।
সে শুধু বলল, ভুপেনবাবু আমাকে পাঠিয়েছেন এটি দিয়ে। আর, বলেছেন যে বিয়েটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয়। উনি একটু বিশেষ কাজে আটকে পড়েছেন, তাই নিজে আসতে পারেননি। তিনি খুব শীঘ্রই বাড়িতে ফিরবেন"।
____________________________________________
 নাম শুভ্রব্রত রায়। তিনি কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। কবি ও সাহিত্যিক শুভ্রব্রত রায়ের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর গ্রামে ১২-ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭ সালে। তিনি বাস্তবের উপরে কবিতা ও লেখালেখি করতে ভালোবাসেন, বিভিন্ন বই ও পত্রিকাতে কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে। পিতা পরমানন্দ রায় ও মাতা শ্যামলী রায়। শুভ্রব্রত রায় বিশ্ববঙ্গ বাংলা সাহিত্য একাডেমি অনুমোদিত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তিনি বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছেন।
____________________________________________
নাম:- শুভ্রব্রত রায়
ঠিকানা:- গ্রাম + পোস্ট - মন্তেশ্বর
জেলা:- পূর্ব বর্ধমান
                   পিন:- ৭১৩১৪৫
মোবাইল নং:- ৬২৯৪৫২০৫৩৯
হোয়াটসঅ্যাপ নং:- ৬২৯৪৫২০৫৩৯

নিলয়ের মননে-- দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়


নিলয়ের মননে
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়

নিলয় বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকেই অনেক সুখে আনন্দে দিন কাটিয়েছে, অভাবের চিহ্ন কোথাও নেই।প্রতি বছর দুবার করে বাইরে যাওয়া, বড়ো স্কুলে পড়াশোনা করা,নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে বিদেশে চাকরি নেওয়া।অনেকটা রূপকথার গল্পের কাহিনী মনে হয়।
সেবার ওরা আগ্রায় বেড়াতে গেছিল, ওখানে অনেক স্থাপত্য শিল্পের দৃষ্টান্ত রয়েছে,তাজমহল তো বিখ্যাত। ঘুরে ঘুরে যত নিলয় দেখে,তত প্রশ্নের পর প্রশ্ন তার মনে উঁকি দেয়, কিছুতেই দমন করতে পারে না।
মহলের মধ্যে কে আছে যে,কান্না শোনা যায়,কে যেন
কাঁদতে কাঁদতে বলে,জানো আমার গল্প, আমি এখানেই বন্দী আছি। সবাই আমাকে দেখতে আসে, কিন্তু আমার কান্না শুনতে পায় না, সবার এতো ভালো লাগে, কেন জানো,এর মধ্যে আমার অস্তিত্ব আছে বলে, আমার ভালোবাসার রক্ত গোলাপ সাদা উজ্জ্বল পাথরের গায়ে, জ্বলজ্বল করে জ্বলে!
অনেক টাকা খরচ করে বানানো সেরা মহলের,প্রতি দেওয়ালে দেওয়ালে আমার কান্না প্রতিধ্বনিত হয়, তাতে তোমরা রোমাঞ্চিত হও।
আর , বলো আশ্চর্য !
কি আছে, যা শুধু অনুভূত হয়।
নিলয় বিড়বিড় করে বললো ভূ , ভূত !
হা হা করে কে যেন, হেসে উঠলো,বললো দাঁড়াও,
আমি তাজমহল বানানোর মিস্ত্রি,এখান ছেড়ে আমিও যেতে পারিনি, কারণ এই মহল বানানোর পর আর কোনো কাজ করতে পারিনি,
ইচ্ছে ছিল, আরও কিছু কাজ করার ,সম্রাট,সে হুকুম দেননি,
তাই আমরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি !
কিসের প্রতিশোধ ? সম্রাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
আর আপনি সেই সম্রাট !
আ- আমি মানে !
হা হা হা হা  ! 
ভূ - ভূত !
ওর মা বলে কিরে ভূত ভূত করছিস কেন? 
কোথায় ভূত ?
কোথাও কেউ নেই, ফালতু চিন্তা করা তোর স্বভাব হয়ে গেছে।
এর মধ্যে লালকেল্লা আগ্রার অনতিদূরে রয়েছে। নিলয় বাবা মায়ের সঙ্গে ওখানে আসে।
ওখানে এসেও একই সমস্যায় পড়তে হয়, যদিও "লালপাথর" "সিনেমার সঙ্গে এই জায়গার তেমন মিল নেই,
তবুও নিলয় ও সিনেমার স্মৃতি আবছা আলোয় ছায়া ছায়া দেখতে পায়, খুনের সময়,যে আর্ত চিৎকারে বলেছিল--- "অমরদা"  , কথাটা কেমন যেন গুলোতে থাকে,
ফতেপুর সিক্রিতে এসে, থমকে যায়। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে, আগে তো কখনও আসিনি , আবার যেন কে ছুটে চলে গেল, আবার সেই ডাক,অমরদা আআআ...
ওকে যেন খুব চেনা লাগে।
দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,
তারপর কিছু মনে নেই !

যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখি বাড়িতে শুয়ে আছি, ঠাকুমা মাথার কাছে বসে আছে, ডাক্তার বললেন,হ্যালুসিনেসন 
আসতে আসতে পরিবর্তন হয়ে যাবে।
বিদেশে ভালো চাকরি করে, একটা বিয়ে দিয়ে দিন, ঠিক হয়ে যাবে।
বড়োলোকের একমাত্র মেয়ে,ডানা কাটা পরির মত সুন্দরি মেয়ে মিলির সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়ে যায়, তারপর
ঘোরাঘুরি সপিং মলে কেনাকাটা,আইনক্সে সিনেমা দেখা ,সি সি টুতে খাওয়া, জমিয়ে আড্ডা,মিলির মধ্যে ডুবে যায় নিলয়, তারপর ধূমধাম করে বিয়ে করে নাইজেরিয়া পৌঁছে যায়।

এখানের মনোরম পরিবেশে 
ছিমছাম বাংলো বাড়িতে মিলির সাজানো সংসার। উইকেন্ডে দুজনে ল্ং- ড্রাইভিংএ যায়, বেড়াতে যায়,
পার্টিতেও যায়।কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু মাঝে করোনার দাপট খুব বেড়ে গেলো, 
আক্রান্ত হয়ে মিলি মারা গেল।

সমস্যা আবার শুরু...
সারা বাংলোময় কে ঘুরে বেড়ায়, গান গায়, সকল হলেই জল পড়ার শব্দ হয়,
ছুটে ছুটে দেখতে গিয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।
গা ছমছম করে,
অফিসে ছুটি নিয়ে নিলয় বাড়ি ফিরে আসে। ঠাকুমাকে 
সমস্যার কথা বলে।
ঠাকুমা নিলয়ের বাবা মা কে জানায়।
নিলয়ের বাবা মা আবার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে,
এবারেও ডাক্তার আবার বিয়ে দিয়ে দিতে বলেন, আরও বলেন, আপনারা ওকে কখনও সময় দেননি, নিজেদের কাজে ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন, ফলে ওর এটা দেখা দিয়েছে,
বাবা মা দুঃখী মনে গরীবের একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিলেন।কোনো ঘটা করলেন না।
সোমা গরীবের মেয়ে হলেও সুন্দরী,শিক্ষিতা।
তাই খুব সহজেই নিলয়ের সঙ্গে সিস্টার সুলভ আচরণে,
নিলয়কে বস করে ফেলে।
কিন্তু ওখানে পৌঁছে সোমারও
কেমন যেন গা ছমছম করছিল, পরদিন সকালে সেই জল পড়ার আওয়াজ, কাছে
যেতে যেতে,সব চুপচাপ।
সোমা এখানে একটা হাসপাতালে সিস্টারের কাজে যোগ দেয়।
সন্ধের সময় চা খেতে খেতে দুজনেই শুনতে পায় কে যেন
গান গাইছে
নিলয় বলে ওঠে মিলি, মিলি এসেছে,
তারপর সব চুপচাপ।
সোমা চিন্তায় পড়ে, সারারাত ঘুমোতে পারেনা,
ওদিকে নিলয় সোমাকে মিলি ভেবে,সোমার সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে নিলয় সোমাকে প্রচন্ড বকাবকি শুরু করে, সোমা খাবার গুছিয়ে হাতের কাছে রেখে, নিজের কাজে চলে যায়।
সামনে থেকে সরে গিয়েও সোমা বেশ চিন্তিত থাকে।
ডাক্তারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে, জানতে পারে ওগুলো মনের ভুল।তাই শক্ত হয়ে সংসার করতে হবে।

নিলয়ের সঙ্গে সোমা মুখোমুখি হতে চায়না,তাই পেছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি ঢুকে, লুকিয়ে থাকে। 

দেখে নিলয় টেনসন করছে,
 বলছে আমাকে কেউ বোঝে না, সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত।
বাবা মা একবারও ভাবে না আমার ওপর দিয়ে কিরকম ঝড় গেল,
আবার কতো বছর পর দেশে ফিরতে পারবো, 
আদৌ কারো সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো কিনা,

এ সোমা  আবার কোথায় চলে গেল, আমাকে না বলে।
আর ওকে কিছু বলবো না।
শেষে
ও আবার আমাকে ছেড়ে...
নাঃ, একটা ফোন করে দেখি।
সোমা ঠিক তখনই বলল, খেতে দিয়েছি।
নিলয় একটু অবাক হলো,
খেতে বসে আবার সেই গান শোনা যায়।
দুজনে দুজনকে চেপে ধরে,

তারপর আবার চুপচাপ!


***দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
৬, হরিচরণ চ্যাটার্জী স্ট্রিট আড়িয়াদহ কোলকাতা--- ৭০০০৫৭
৭০০৩২৪০৯৫৭


ভ্যালেন্টাইন ডে----অদিতি ঘটক


ভ্যালেন্টাইন ডে
----অদিতি ঘটক

"আমি যে কি বলে তোকে কৃতজ্ঞতা জানাবো ভেবে পাচ্ছি না। আমি তো মরমে মরে ছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বটা এইভাবে নষ্ট হয়ে গেল বলে। তুই যে এত..দি..ন পর আমায় ডেকে কথা বলতে চাইলি আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ দিলি তার জন্য তোকে ধন্যবাদ জানবার ভাষা নেই।
        অয়ন, আমি সত্যি বলছিরে, উষশীকে তোর থেকে কেড়ে নেবার অভিপ্রায় আমার কোনোদিনই ছিল না। আমি জানতামও না তুই ওকে ভালোবাসিস।
 তুই তো জানিস আমি উষশীকে টিউশনি পড়াই। আরো পাঁচজনকে যেমন পড়াই, তেমনই। টিউশনি পড়িয়েই তো আমার হাত খরচা ওঠে। তুই তো জানিস, আমাদের অবস্থা। পকেটমানি দেওয়ার মত ক্ষমতা বাবার আর কবে ছিল। বরাবর নিজেই টিউশনি করে আর স্কলারশীপের টাকায় পড়াশোনা এবং অন্যান্য সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়েছি। তুই তো সব জানিস। তোর কাছে তো কোনো কিছুই লুকনো নেই। আমাদের বন্ধুত্ব তো কোনোদিন তেমন ছিল না রে। তুই তো এটাও জানিস, উষশীর মা নেই। জানিসই তো ও কেমন চাপা স্বভাবের মেয়ে। ওর সুবিধা অসুবিধার কথা কোনোদিনও মুখ ফুটে বলে না।       কলেজ ফেরত পড়াবার জন্য উষশীদের বাড়ি যেতেই সেদিন উষশীর শয্যাশায়ী বাবা আমার হাত চেপে ধরে উষশীর সব দায় দায়িত্ব আমায় সঁপে দিয়ে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিও কম হতচকিত হয়নি কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার কথাও ফেলতে পারিনি রে---
বিশ্বাস কর, তবুও আমি উষশীকে আলাদা ভাবে জিগ্গেস করে ছিলাম। ওর আপত্তি আছে কিনা। স্বল্পভাষী উষশী দুদিকে মাথা নেড়ে না বলে তার সম্মতি জানিয়েছিল।
◆◆
 অয়ন ! মেল ট্রেন আসছে, লাইনের ধার থেকে সরে আয়। এবার তো আমার দিকে ফের। মুখ ঘুরিয়ে অন্তত একবার তাকা আমার দিকে। 
  আমি হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি-- যদি কোনো শাস্তি দিতে চাস আমি মাথা পেতে---  কথা শেষ হবার আগেই মেল ট্রেনটা স্টেশন কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেল। কেউ কিছু বোঝার আগেই অয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ল, রুদ্রেশও দৌড়ল অয়নকে বাঁচাতে-- কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। অয়ন লাইনের তলায়, রুদ্রেশ ট্রেনের গতির টানে নীচে। লাইনের পাশে একদম প্লাটফর্মের ধার ঘেঁষে পড়ে।
◆◆
এই চিত্রনাট্য যখন অভিনীত হচ্ছে তখন দুই বন্ধুকে অনুসরণ করে আসা আরও দুই বিশেষ বন্ধু উষশী ও  ঋষিতা হাতধরাধরি করে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে সব দেখছে--

 দুই বাল্যবন্ধুর থ্যাতলানো দেহ দেখে আর উষশীর মুখের অদ্ভুত প্রশান্তি দেখে ঋষিতার উষশীকে ধরে থাকা উষ্ণ মুঠোটা শীতল, শিথিল হয়ে খসে পড়ে। ঋষিতা স্টেশনের উল্টো দিকে দৌড়তে থাকে। 
 উষশীকে সে যতই ভালোবাসুক তবুও এই নৃশংস, অভিশপ্ত ভালোবাসা সে চায় না। এই নিষ্ঠুর প্রাপ্তি থেকে ঋষিতা অনেক দূরে পালাতে চায়। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেও বেশিদূর এগোতে পারেনা। এক ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে। কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন ওকে লাইনের উপর জোর টেনে আনে। অসম শক্তির লড়াই এ সে হেরে যায়। আর সেই সময়ই একটা থ্রু ট্রেন.... উষশীও এই এখানেই...। 

বলুন ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপনের এটা উপযুক্ত জায়গা কিনা। দেখুন রেল লাইনটা কেমন মুঠো মুঠো লাল রক্ত গোলাপ এ  সেজে---
◆◆
কি করছিলেন কি? মরবার শখ হয়েছে? দেখছেন না থ্রু ট্রেন। হাতটা ধরে টেনে না আনলে তো একেবারে..
--- না, মানে, চিঠি, আমন্ত্রণপত্র, এটা তো পরিত্যাক্ত স্টেশন, রক্তগোলাপ, ভ্যালেন্টাইন ডে ...
পরিত্যাক্ত! রক্তগোলাপ, ভ্যালেন্টাইন ডে! হাহাহা... এইবার আপনি...! হাহাহা.....
★★★★★★★★★★★★★★★★
 

***অদিতি ঘটক
 চুঁচুড়া
হুগলি

Sunday 5 June 2022

নায়িকা-- শিখা মালিক


নায়িকা
শিখা মালিক 

নদী  থেকে কিছু টা দুরে দুর্গ টা অনেক পুরানো অনেক  লতাপাতা ঘেরা,কোথাও আবার দেওয়ালে গায়ে গায়ে বট গাছের চারা। অনেকটা মাঠ পেরিয়ে খেলতে আসে ন্যাপলা বুধো গবা হরি।
দুর্গের  ভিতর  অনেক ফলের গাছ ফল পেকে পড়ে থাকে কেউ কুড়ায় না।গবার দাদু বলে ওখানে  ভূত আছে তাই কেউ যায় না। গবারা চুপি চুপি দুপুর বেলা চলে আসে ,অনেক আম পড়ে আছে ওরা কুড়ায় আর খায় গবা বলে ন্যাপলা চল কে যেন গেট বন্ধ করছে ।ন্যাপলা বলে এখানে  কে আবার বন্ধ করবে   আবার একটা অদ্ভূত  শব্দ দুর্গের  ভিতর তখন ওরা ভয় পেয়ে দৌড়ে  পালিয়ে  আসে।
কদিন পড়ে গবারা দেখলো বড় বড় গাড়ি  এসেছে দুর্গ টার সামনে ,গবা বলে ও হরি দেখ  লাঠি লাগানো ওগুলো কি রে! হরি ফোকলা দাঁতে আম খেতে খেতে বলে ও তো ক্যামেরা ।একটা সুন্দর দেখতে মেয়ে মাথায় টুপি চোখে কালো চশমা হাঁটু পর্যন্ত  জামা পরে  গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ন্যাপলাদের সামনে,ওদের জিজ্ঞাসা  করে -"তোদের কোথায়  বাড়ি"?।ন্যাপলা বলে উই মাঠ পেরিয়ে ,কিন্তু  তোমরা কি করতে এয়েচো গো? সুন্দরী  বলে - সিনেমার শুটিং  করতে ।গবা তখন বলে ওঠে ও দিদিমনি ওখানে ভূত আছে ।নায়িকা বলে আমরা ভূতের সিনেমা করতেই এসেছি,ন্যাপলা নাচতে থাকে কি মজা কি মজা সিনেমা হবে, সন্ধ্যা  হয় ছেলেরা গাঁয়ে ফিরে আসে দুর্গে তখন শুটিং  শুরু  হয়  ওরা যখন মেকাপ নিচ্ছিল তখন কয়েকজন মেয়ের হাসির শব্দ  শুনতে পায় ,সবাই খোঁজাখুঁজি করে কিন্তু  ওখানে সেরম কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না ওরা শুটিংয়ে মন দেয় দোতলার জানালায় সাদা শাড়ি পরে খোলা চুলে নায়িকা গান গাইছে নীচে  বাগানে দাঁড়িয়ে  বিভোর হয়ে দেখছে রাজা বেশে এক অভিনেতা । আচমকা সব লাইট নিভে যায় একটা বিকট চিৎকার  কেউ যেন নায়িকাকে ধাক্কা  দিয়ে নীচে ফেলে দিল।রাতের অন্ধকারে  সব গাড়ি  অচেতন নায়িকাকে নিয়ে শহরে চলে গেল।দুর্গের  পাশে ক্যাম্পের সামনে একটা ব্যানার সাদা শাড়ি পরে খোলা চুলে নায়িকা হাসছে দেখে ন্যাপলারা শুধুই  কাঁদছে।

Saturday 4 June 2022

ভূতের গল্প-- বহ্নি শিখা (উষা দত্ত)


ভূতের গল্প-- 
বহ্নি শিখা (উষা দত্ত)

শারদীয় মহানবমী। বাড়িতে পূজো হচ্ছে।
মিতার শ্বশুর বাড়ি। আগে হতো না।
বারোয়ারি হলেও প্রতি বছরই তাদের বাড়িতেই হয়। মিলন উৎসবহিসেবে। 
পাঁচ ভাই এর মধ্যে চার ভাইই বাড়ির বাইরে থাকে। চাকুরির কারনে। চার বোন সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। তাদেরও বাপের বাড়ি আসার সুযোগ নেই। সবার ভাটি এলাকায় বিয়ে হয়েছে। বাড়ি থেকে অনেক দূর,আসতে সারাদিন লেগে যায়। তাহেরপুর, দত্তখিলা কলমাকান্দা এসব এলাকায়। রাস্তাঘাট জঘন্য রকম খারাপ। তবু্ও তো বাপের আসতে সব মেয়েদের মন চায়। 
বাবা গত অনেক দিন আগে। দাদারা আছে,মা আছে,ভাইপো,ভাই ঝিরা আছে দেখতে মন চায়। ভাই ঝিদেরও বিয়ে টিয়ে হয়ে তারা সংসারী। ওরা সবাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক। ছুটিছাটা পেলে বাড়িতে আসে। ওরাও অনেক দূরের বাসিন্দা। সূদুর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওদের ঘর-গৃহস্থালী। চাকুরী। সবাই এসেছে। গমগম করছে বাড়ি, সব প্রিয়মুখ। 
আমি মিতা। যেতে পারিনি। শ্বাশুড়ি মা আমার কাছে থাকে,ওজন জনিত সমস্যা। কোত্থাও যাওয়া হয় না আমার। কোন ছেলে মেয়ে নেই।শ্বাশুড়ি মা -ই এখন সন্তানের মতো পুরো সময় ধরে থাকে। তাকে আগলে রাখতে হয়। সেবা যত্ন করতে হয়। স্বভাবতই মনটা ভালো নেই।
শ্বাশুড়ি মায়ের মন তো আরও খারাপ। তিনি পূজোয় যেতে পারলেন না। সবাই এসেছে দেখতে পারলেন না। কান্নাকাটি করে। সারাক্ষণ। বুঝিয়ে সমঝিয়ে রাখি।
এর মধ্যেই ননদ দুজন চলে এসেছে বাসায়। বাড়ি থেকে আমার বাসা দেড় ঘন্টা, ট্রেনে। ওরা এসে বলল,বৌদি দাদাকে নিয়ে তুমি আজ চলে যাও আমরা মা কে দেখব।
মনে মনে বলি, বেশতো ভালোই হলো। কতদিন ঘর থেকে বের হইনি। বিপুল আমার স্বামী। সে রিটায়ার্ড। দু বছর হলো। দেশে,দেশের বাইরে সে একাই ঘুরে বেড়ায়। আমাকে একা রেখে চলে যায়,নানা ছুতো ধরে। সে নিয়ে আমি ওকে যে কিছু বলি না তা নয়। ও কিছু বলে না।
অবশেষে আমরা রওনা হলাম। সেদিনই ফিরব বলে।
পৌঁছে গেলাম পূজোর আগেই। উপোষ  রেখে যেতে পারিনি। জলের ঘাটতি হলে
শরীর খারাপ করে। বিপুল নাস্তিক।সে পূজো পার্বনের আয়োজনে মিলনে থাকলেও তাকে দু কথা মন্ত্র বলে অঞ্জলি দিতে দেখিনি। দেওয়াতেও পারিনি। সবটাই মনের ব্যাপার। বাকিটা তার ভেতরের গোপন ভক্তি বিশ্বাস। 

 আমি নাস্তিক ও নই আস্তিকও নই। মন চাইলে খেলি নয়তো নিজেই নিজের মতো কথা বলি। না ঘরকা না ঘাটকা।
ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই  পৌঁছে গেলাম বাড়ি। বড় রাস্তা পেরিয়ে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে ছোট গলির মতো রাস্তা। আমরা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছি।এটুকু পেরুলেই বিশাল পুকুর। সেই পুকুরের বাম পাশের পাড় ধরেই যেতে হয়। পাড়ের কোনায় বিশাল এক বেল গাছ। তারপর আম কাঠাল লিচু খেজুর সুপারি, সজনে গাছ শিল করই সেগুন গাছের সারির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি,বাড়ি থেকে সকলে একে একে সকলে বেরিয়ে আসছে। সবাই খুব খুশি।
বাইর বাড়িতে মন্দির। অনেকটা জায়গা জুড়ে আরতি এবং পূজোর নৈবেদ্য তৈরীর আঙিনা।বাঁশের বেড়া। এর দশ হাত দূরে পুকুর। যেতে যেতে  কুশল বিনিময় করে মায়ের মন্দিরে প্রণাম করে বাড়িতে গেলাম। খুব ভাল্লাগছে আমার। 
বাকিটা সময় কখন কিভাবে চলে গেলো টের পাইনি। এখন ফেরা পালা। বিকেল পাঁচটা বাজে। জা-এরা খুব পীড়াপীড়ি করছে থাকতে,আমারও ইচ্ছে কিন্তু,,,  
বিপুল রাজি না,কারণ বোনেরা আসছে,
এতদিন পরে তাদের একটু ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে। অগত্যা বিপুলের মন চেয়ে চলে এলাম। রাতে আর কিছু করিনি। 
সকালে রান্না বান্না হলে ওরা খেয়ে চলে গেল।
__________________

মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ময়মনসিংহ মেডিকেলের ডাক্তার বাসায় এসে দেখে গেলেন। অনেকগুলো টেস্ট দিলেন,সব নরমাল।

মানসিক শান্তির জন্য ও কিছু দিলেন না।
শুধু জল খেতে বললেন বেশি করে। মা জল একটু কমই খেতেন। যা হোক,জোর করে খাওয়াই।ডায়াবেটিস, প্রেসার ছিল আগে থেকেই। সেগুলো যেমন চলছিল তেমনই চলবে।

কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে মা'র তান্ডব তত বাড়তে থাকে। ভরা শীতকাল। যেহেতু বসতে পারেন না ওজন জনিত কারনে।
সবটাই করে দিতে হয়। এমন কি পায়খানা প্রসাবও করার সময় কাছে থাকতে হয়।অথচ সেই কি না রাত হলে বিকট মানসিকতা নিয়ে জেগে থাকে। 

একদিন হঠাৎ শব্দে গিয়ে দেখি পুরো উলঙ্গ হয়ে সারা ঘরময় ঘুরছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মাঝরাত। বিপুলকে ডেকে 
তুললাম,বললাম,তুমি দাঁড়িয়ে থাক।আমার ভয় করছে। মাকে জিজ্ঞেস করলাম মা আপনি এই অবস্থা কেন? শীতের মধ্যে? কাপড় কোথায়। কম্বল কোথায়? আমি দেখছি সব কিছু গুছিয়ে জড় করে রেখেছে খাটের এক কোনায়।
মা বলে,ওরা আমাকে নিতে চায়। আমি বললাম কারা? মা বলে কারা তুমি জান না?  আমারে খালি ঘোরায়। এই যে, দেখ ওরা দাঁড়ায়া আছে! তারা পাঁচ জন। 

আমি বলি,কই?  আমি তো কাউকে দেখি না। মা বলে, তুমি দেখ না? জান?ওরা  আমারে মারে। 

মা' য়ের কথা বলা, চোখে তাকানোর ভঙ্গি কোনটাই সুস্থ নয়। ভয়ে আমার সারা শরীর জমে আসছে। গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিতেও ভয় করছে। 

সেদিন কোনমতে কাপড় না দিয়ে উপর থেকে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে ঘরে আগুন জ্বেলে রেখেছি। ছোট বেলা শুনতাম আগুন দেখে ওরা চলে যায়। টোটকা যা মনে এসছে তা দিয়ে জল ছড়া দিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি।
সেদিন চুপচাপ চলে গেছে। কিন্তু তারপরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। টোটকায় কোন কাজ হয় না। আমি ভয় পেয়ে ননদকে আনালাম। ননদ টি মায়ের অবস্থা দেখে কেঁদে কেটে অস্থির,ও যে  আরো বেশি ভয় পায়।  কোনমতেই  এসব সমস্যা যাচ্ছে না। পালা করে রাত জাগি।
কিন্তু দেখা যায় যে সময়টাতে একটু অন্যমনস্ক বা তন্দ্রার মতো হলে ঠিক সে সময়টাতে সে তার কাজ করে ।

ওদিনেরও এক ঘটনা। রাত তখন দুটো বাজে মাকে গুছিয়ে জলটল খাইয়ে একটু ঘুমিয়েছি।  রাত তিনটা। একটু পরেই ননদ ডাকছে। গিয়ে দেখলাম মা খাটের নীচে।

 আমি যেন সচক্ষে ভূত দেখতে পাচ্ছি।ওই ঘরের সব এলোমেলো।  যেন তান্ডব বয়ে গেছে। রাতেই ঘরের সব জিনিষ পত্র বের করে মা কে  নীচে ঘুমানোর জায়গা করে দিই। কিন্তু সে নীচে ঘুমুবে না। কিছুতেই না। 

আমি জিজ্ঞেস করি মা, এতো বড় বিছানা আপনি কি করে পড়ে গেলেন?
মা বলে ওরা সাতজন কোমর জলে খাড়ায়া  আমারে টেনে নামালো। আমি বলি, আপনি ব্যথা পাননি? মা বলে না,ব্যথা পাইনি।আমি এতো না,না করলাম কে শুনে কার কথা আমাকে নামিয়েই ছাড়লো।

পরদিন খাট খুলে বাইরে রেখে দিল বিপুল।
ঘরে বিছানা ছাড়া কিছু নেই। 
রাত হলেই যত ঝামেলা। দিন হলে মা এমন ঘুমায় যে মুখে খাবার নিয়েও ঘুমিয়ে পড়ে।
কয়েকদিন আগে ভর দুপুরে আমি রান্না চাপিয়েছি, হঠাৎ এমন চিৎকার শুরু করলো,দৌড়ে গেলাম,বললাম, কি হয়েছে মা? বলে,একটা লোমশ হাত আমার মাথায় বুলাইতেছে। নানান কথা বলে,চলে আসি।

কোন বিরাম নেই। আমি যেন ভূতের সাথে পাল্লা দিয়ে দিন যাপন করছি।এখন দিনের বেলাতেও ঘরে আগুন ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে রাখি। কত শুনেছি তারা নাকি আগুন দেখে ভয় পায়। কিন্তু কোথায় কী?

এখন সমস্যা দাড়ালো অন্য। আমাকে একদম পছন্দ করছে না। দেখতেই পারে না। এমন সব কথা বকা বকি করে যা এযাবৎ শুনিনি,মা'র মুখে। তার ছেলে মেয়েরা শুনে লজ্জায় আমার সামনে আসে না। মাকে বুঝায়, তুমি এসব কি করছ? কি বলছ? মা বলে আমি জানিনা তো। আমি কি করি, কি বলি।

 যতসব পুরনো আলাপ,করবে, সব বলবে,খুট খুট করে। যে আসে সবাইকে চেনে, আলাপ করে,হাসি ঠাট্টাও করে।

 আমরা ভেবেছি মাথায় কোন সমস্যা। না,তাও নয়।অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো সব নরমাল। কারোর সাথে কথা বললে খুব ভেবে চিন্তে কথা বলেন। অনেক সময় জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলেন।

 কিন্তু একটু আড়াল হলেই ঝরঝরে। খুব স্পষ্ট ভাষায় চণ্ডালিনী বকা ঝকা। একা তার কাছে যেতে সাহস হয় না।
রহস্যের কিনারা মিললো তখনই যখন জানতে পারলাম সারারাত  ধরেই তিনি বসার জন্য চেষ্টা করতেন। 

অথচ তিনি বসতেই পারেন না। হিপের কাছে ভেঙে গেলে যথার্থ চিকিৎসায় তিনি হাঁটতে পারতেন ওয়াকার নিয়ে। দিনরাত নক্সী কাঁথা সেলাতেন। বসে থেকে থেকে ওজন এতটাই বেড়ে যায় যে বসে থাকার ক্ষমতা হারিয়েছেন। কোন কথা শোনেন নি।

এখন তিনি ভাবেন বড় ছেলেটা বলেছিল,মা আমার জন্য একটা নক্সী কাঁথা সেলাই করে দাও। মনের গোপন ইচ্ছে, যে করেই হোক বসতে হবে।
________________

বাঁশবাগানের ভূত -- সাবিত্রী দাস

বাঁশবাগানের ভূত সাবিত্রী দাস আজ যে এত দেরী হয়ে যাবে কে জানতো! পরের হাটবারে ভোর থাকতে বেরোলে দুধ বেচে ঠিক সময়ে  ফিরতে পারবে পানুর...